মশা বৃত্তান্ত,
উমাশংকর: হয়তো কোনো এক সন্ধ্যাবেলায় আপনারা বেশ কয়েকজন বন্ধু একসাথে আড্ডা দিচ্ছেন চায়ের দোকানে। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন বেশ কয়েকটি মশা আপনার কাছে ঘুরঘুর করছে। সুযোগ পেলে আপনার ত্বক থেকে চোঁ করে টেনে নিচ্ছে রক্ত। চুলকানি শুরু হলেই আড্ডার আনন্দ বিরক্তিতে পরিণত হচ্ছে। তখন এক থাপ্পড়ে সেটিকে জড় পদার্থে পরিণত করতে আপনার মুহূর্তও সময় লাগে না। বেশ কয়েকটি মেরেও ফেললেন। তবু দেখছেন বার বার মশা এসে আপনাকেই কামড় দিচ্ছে। বাকিদের দিকে ওদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। এবার আপনার মনে প্রশ্ন জাগবেই আপনি কি তাহলে মশাদের টার্গেট? এমনটাও কি সম্ভব? মশা ব্যক্তিবিশেষে আক্রমন করে?
এমন প্রশ্ন যদি আপনার মনে ঘুরপাক খায় তাহলে তার উত্তর খুঁজতে এই প্রতিবেদন আপনাকে পড়তে হবে।
হ্যাঁ এটা সত্যি মশা ব্যক্তি বিশেষে আকৃষ্ট হয়। বিশেষ কতকগুলি কারণ আছে যে কারণগুলির জন্য মশারা আকৃষ্ট হয়। প্রথমে জেনে নিই মশারা কেন রক্ত খায়।
সাধারণত স্ত্রী মশা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের কামড় দেয়। এর কারণ হলো রক্তে থাকা প্রোটিন ও ফ্যাটের কিছু অংশ তাদের ডিম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয়। পুরুষ মশা প্রাণীদের কামড় দেয় না। এমনকি স্ত্রী মশাও প্রাণীদের রক্ত না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারে। শুধু ডিম উৎপাদনের জন্য তাদের রক্ত প্রয়োজন হয়। মশার মূল খাবার হলো ফুলের মধু, ফলের রস, গাছের রস ইত্যাদি।

মানুষেরাই সবচেয়ে পছন্দের টার্গেট
এবার প্রশ্ন হলো মানুষ বাদ দিলেও আরো অনেক প্রাণী আছে তাদের রক্ত চোষার জন্য স্ত্রী মশা যায় না কেন?
উত্তর হলো – যায়। মানুষ বাদ দিয়েও গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বেড়াল, হরিণ, ইঁদুর, বাদুড় ছাড়াও আরো কিছু উভচর, সরীসৃপ বা অন্যান্য কিছু প্রাণীও মশার শিকারের টার্গেট হতে পারে। তবে সবচেয়ে পছন্দের হলো মানুষ। এর প্রথম কারণ সহজলভ্যতা। মানুষকে অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে সহজেই পেয়ে যায়। দ্বিতীয় কারণ হলো মানুষের ত্বক। মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণীরা যেহেতু পোশাকের ব্যবহার জানে না তাই তাদের ত্বকের উপরিভাগে লোমের পরিমাণ বেশি সেই তুলনায় মানুষের ত্বক অনেক বেশি উন্মুক্ত। ফলে মানুষের ত্বকের উপর বসে আলাদাভাবে রক্ত চোষার জায়গা খুঁজতে হয় না।
বন্ধুদের মধ্যে আপনি কেন
এবার বলবো যে গল্প দিয়ে এই প্রতিবেদন শুরু করেছিলাম সেটির কথা। অনেকজন বন্ধুর মাঝে মশাগুলো আপনাকে কেন টার্গেট করছিল। এর পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে।
বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইডকে মশা বেশ ভালোভাবে চিনতে পারে। তাই যে সব মানুষ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে তারা মশাদের বেশি টার্গেট হয়। এই কারণেই একজন পাতলা ব্যক্তির চেয়ে একজন স্থূলকায় ব্যক্তির কাছে মশারা বেশি যায়।
ঘামের গন্ধ দ্বারাও মশারা আকৃষ্ট হয়। আমাদের ত্বকে থাকা অণুজীব (যেমন – ব্যাকটিরিয়া) ঘামের মধ্যে থাকা কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাটি অ্যাসিড ও পেপটাইডগুলোকে ভেঙে দেয় এবং উদ্বায়ী কার্বন ডাই অক্সাইড, ল্যাকটিক অ্যাসিড ও অন্যান্য জৈব যৌগে পরিণত করে। এই জৈব রাসায়নিক সংকেতই মশাকে অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে থেকে মানুষকে আলাদাভাবে চিনতে সাহায্য করে। তাই যাদের গায়ে ঘাম বেশি তারা অন্যান্যদের চেয়ে মশাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়।
মশাকে আকর্ষণের ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপের একটা ভূমিকা আছে বলে দেখা গেছে একটি সমীক্ষায়। তাতে জানা যায় “O” গ্রুপের রক্তের প্রতি মশারা বেশি আকৃষ্ট হয়।
গর্ভবতী অবস্থায় মহিলারা যেমন বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে তেমনি তাদের শরীরের তাপমাত্রাও থাকে বেশি। তাই দেখা যায় সাধারণ মানুষের তুলনায় গর্ভবতী মহিলাদের বেশি পরিমাণে মশার কামড় খেতে হয়।
গাঢ় রং এর মশাদের বেশি আকর্ষণ করে। যেমন গাঢ় নীল, গাঢ় বেগুনি, গাঢ় সবুজ, কালো ইত্যাদি।
আরো একটি গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয় হলো মদ্যপান। সাধারণত যারা মদ্যপান করেন তাদের প্রতি মশারা বেশি আকর্ষিত হয়। এর কারণ হিসেবে বলা যায় মদ খাওয়া ব্যক্তি বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে এবং তার হার্টরেট বেশি হওয়ায় ঘামের পরিমাণও বেশি হয়।
এছাড়াও আরো কিছু জেনেটিক বিষয় আছে যেগুলোর কারণে হয়তো মশার কাছে আপনি অন্যদের তুলনায় বেশি আকর্ষণীয়। সঠিক কি কারনে মশা আপনাকে পছন্দ করবে সেটা শুধু মশারাই জানে। আমি শুধু কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করলাম।
শেষ করছি চুলকানি দিয়ে। মশা কামড়ানোর পর কেন চুলকায়। তার কারণ হলো মশার লালায় থাকা প্রোটিন। মশা যখন রক্ত খাওয়ার জন্য কামড়ায়, তখন তারা তাদের শুঁড় দিয়ে চামড়ায় ছোট ছিদ্র করে। রক্ত শোষণের সময় যাতে জমাট না বাঁধে এবং সহজে রক্ত শোষণ করতে মশা তাদের লালারস রক্তে মিশিয়ে দেয়। মশার লালারসে থাকা প্রোটিন ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ আমাদের শরীরের জন্য “বহিরাগত” পদার্থ। তাই শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে উঠে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে শরীর হিস্টামিন নামক রাসায়নিক নিঃসরণ করে, যা আক্রান্ত স্থানে রক্তনালীগুলো প্রসারিত করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। হিস্টামিন নিঃসরণের কারণে নার্ভ বা স্নায়ুর শেষপ্রান্তগুলো উত্তেজিত হয়, যা চুলকানির অনুভূতি তৈরি করে। হিস্টামিন আক্রান্ত স্থানের চারপাশে রক্ত প্রবাহ বাড়ায় যাতে বেশি পরিমাণে শ্বেত রক্তকণিকা(WBC) এসে যেতে পারে। কেননা মশার লালারসে বাড়তি উপহার হিসেবে ডেঙ্গু, চিকেন গুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া সহ আরো নানারকম জীবাণু থাকে। তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। এই কারণেই আক্রান্ত স্থানে প্রদাহ হয় ও ফুলে যায়।